আঁধারে আলো সন্ধিক্ষন

আঁধারে আলো সন্ধিক্ষন
কলমে ঃ -  জিৎ দত্ত
আজ প্রায় চল্লিশ বছর পর এই গ্রামে এলো মনিরুল। যখন গেছিল তখন ওর বয়স দশ কি বারো, এখন মনিরুলের বয়স বাহান্ন। ও এখন শহরের নাম করা প্রমোটার। এখানে ও একটা জমির খবর পেয়ে এসেছে। 
গ্রামটাকে দু চোখ ভরে দেখছিল মনিরুল, ওর ছোটবেলার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই গ্রামটার সাথে। এখন পাকা রাস্তাঘাট, বড় বড় দোতলা, তিনতলা বাড়ি হয়েছে চারিদিকে, তবু এখনো সেই মাটি মাটি গন্ধটা আজও যেন পুরোপুরি ভাবে যাইনি। 
পিঠে ব্যাগটা নিয়ে হাঁটতে থাকে মনিরুল। পুরানো স্কুলের পাশ দিয়ে ঘেঁটুদের বাঁশ বাগানের রাস্তাটা এখনো একই রকম আছে। এখান দিয়ে তালদিঘি যাওয়ার একটা শর্টকাট রাস্তা আগে ছিল, সেই রাস্তাটা ধরেই হাঁটতে থাকে ও। তালদিঘির পাড়টা এখন বাঁধানো হয়েছে, পাড়ে একটা চায়ের দোকান বসেছে। 
এক কাপ চা খায় মনিরুল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ও যে জমিটা কিনতে এসেছে সেটা রায় দের বসত জমি। রায় দের কথা শুনতেই মনিরুলের অনেক কথা মনে পড়ে যায়, সাথে আর একজনের কথা ও ওর মনে পড়ে, অপর্ণা দিদি।
তখন মনিরুলের বয়স সাত কি আট, ওর আব্বা ছিলেন রায়দের মালি। রায় রা এক সময় এ গ্রামের জমিদার ছিলেন, পরে জমিদারি না থাকলেও তার প্রতাপটা কিন্তু বজায় ছিল।
তখন শরৎকাল, দূর্গা পুজোর চলছে। গ্রামে তখন একটাই পুজো হত রায়দের বাড়িতে। সারা গ্রামের লোক ভিড় করত সেই পুজো দেখতে।
মনিরুল ও সেবার গেছিল আব্বার সাথে পূজো দেখতে। এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুগ্গা প্রতিমার দিকে তাকিয়ে ছিল ও।
হঠাৎ ও দেখে একটা বছর পনেরোর মেয়ে ওকে বাড়ির মধ্যে থেকে হাত নেড়ে ডাকছে। ভয় পেয়ে দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে মনিরুল। কিছুক্ষণ পর আবার মুখ বাড়ালে দেখে মেয়েটা আবার হাসি মুখে ওর দিকে চেয়ে হাত নেড়ছে। সাহস করে মেয়েটার কাছে যায় মনিরুল। মেয়েটা ওর গালে হাত বুলিয়ে ওর নাম জিজ্ঞেস করে, মনিরুল উত্তর দেয়, “আমার নাম মনি”। মেয়েটা বলে, “তুই আমায় দেখে ভয় পাচ্ছিলি কেন?”, মনিরুল ভয়ে ভয়ে বলে,“তুমি যদি মারো”। মেয়েটা হেসে লুটোপুটি খেয়ে যায়, হাসতে হাসতে মেয়েটা বলে,“এ মা তোকে মারব কেন? আচ্ছা তুই মা দুগ্গাকে নম করেছিস?”,মনিরুল বুঝতে না পেরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে মেয়েটা নিজেই ওর হাত দুটো ধরে জড় করে ওর কপালে ঠেকিয়ে দেয়। তারপর একটা শালপাতায় কটা ফলের টুকরো, মিষ্টি, আর নারকেল নাড়ু নিয়ে এসে ওর হাতে দিয়ে ওর গালটা টিপে বলে,“ নে ধর, খেয়ে নে। কাল আবার আসবি হ্যাঁ”। মনিরুল এবার সাহস করে জিজ্ঞেস করে। “তোমার নাম কি?”, মেয়েটা বলে,“আমার নাম অপর্ণা। তুই আমায় অপর্ণা দিদি বলবি, ঠিক আছে। আচ্ছা এখন যা, কাল আবার আসবি কিন্তু”।
এর পরদিন আবার পুজো দেখতে যায় মনিরুল, সেদিন ও অনেক গল্প করে অপর্ণা দিদির সাথে। আসতে আসতে একটা সখ্যতা গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে। অপর্ণা দিদির ভাই বোন ছিলো না, মনিরুলেরও না, ফলে একে অপরকে বেঁধে ফেলেছিল এক মায়ার বন্ধনে।এরপর প্রায়ই রায়দের বাড়ি অপর্ণা দিদির সাথে দেখা করতে যেত মনিরুল। 
তারপর একদিন গ্রামে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে কোন ঝামেলার জন্য ওর বাবা শহরে চলে আসে, ও তখন খুব ছোট। ওর আজও মনে আছে সেদিন খুব কেঁদেছিল অপর্ণাদিদি। মনিরুলের হাতে একটা নারকেল নাড়ুর পুটুলি দিয়ে বলেছিল, “রাস্তায় খেয়ে নিস। মনি তুই যখন বড় হবি আসবি তো তোর অপর্ণাদিদির সাথে দেখা করতে?”, কোন উত্তর দেয় নি মনিরুল, শুধু ঘাড় নেড়েছিল।, আসলে ওর ও সেদিন খুব কষ্ট হচ্ছিল দিদির জন্য।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে রায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যায় মনিরুল। দূর থেকে কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ওর খেয়াল হয়, আরে আজও তো সেই দুর্গা পুজো, কাজের চাপে এখন আর এসব মনেই থাকে না মনিরুলের। 
এখন আর আগের মতন জৌলুস না থাকলেও, পুজো হয় রায়বাড়ি তে। মনিরুলের চোখ বাড়ির এদিক ওদিক ঘুরে একজনকে খুঁজতে চেষ্টা করে। মণ্ডপের পাশে বসে ফল কাটছিল সাদা কাপড় পরা এক বুড়ি আর হাসিমুখে অন্য লোকেদের এটা ওটা করার ফরমাইশ করছে, একটু বাদেই সন্ধিপুজো সে তার আয়োজন করছে। বুড়িটাকে চিনতে পারে মনিরুল, পাশে গিয়ে আসতে করে ডাকে,“দিদি”। ভদ্রমহিলা মুখ ফিরিয়ে তাকায়, মনিরুল তাকে ঢিপ করে একটা প্রনাম করে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বুড়ি, জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে গা বাছা?”,
“নিজের ভাইকে চিনতে পারছ না দিদি! আমি মনিরুল গো, তোমার মনি”।
কিছুক্ষণ মনিরুলের দিকে তাকিয়ে থাকে বুড়ি, তারপর তাড়াতাড়ি হাতের কাজ ফেলে উঠে আসে, মনিরুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে অপর্ণা দিদি, “মনি, তুই আমার মনি, এতো দেরি করে এলি ভাই। এতো দিনে মনে পড়ল এই দিদিকে”। কাঁদতে থাকে মনিরুল ও, অনেকদিন পর প্রোমটার মনিরুল খুঁজে পায় সেই দেয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়া ছোট্ট মনিকে। ঠিক সেই সময় বেজে ওঠে সন্ধিক্ষণের পুজোর ঘণ্টা। জাত,বর্ণ সব কিছুর উর্ধে বাতাস ধ্বনিত করে উচ্চারিত হতে থাকে এক মহামিলনের মন্ত্র।

Post a Comment

0 Comments