শখ ছিল তাঁর পাইলট হওয়ার। পাইলট হতে পারেননি, হয়েছেন কবি৷ লিখেছেন-
“আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা
তোমরা এ যুগে সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা।
আমরা যখন আকাশের তলে ওড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি
তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।”
শৈশব:
ভীষণ শান্ত মেয়ে ছিলেন তিনি। তাঁর বয়স যখন
মাত্র সাত মাস তখন বাবা নিরুদ্দেশ হন। মায়ের সাথে ছোট্ট সুফিয়া চলে আসেন
নানাবাড়িতে। সে সময় বাঙালি মুসলিম মেয়েরা কঠোর পর্দা প্রথা মানতো। নানাবাড়ি
ছিল বিশাল আর সব কিছুর চাইতে সুফিয়াকে বেশি টানতো মামার লাইব্রেরি।
গোপনে মায়ের সাহায্যে লাইব্রেরি থেকে বই পড়তেন। কারণ, তখন মেয়েদের পড়া ছিল
বারণ। তখন পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি-ফারসি
শেখার ব্যবস্থা ছিল। তবে বাংলার চর্চা সেভাবে হত না। রাতে যখন মামা
দেশবিদেশের গল্প আর উপন্যাস বোঝাতেন ছোট্ট সুফিয়া মন দিয়ে শুনতেন। ধীরে
ধীরে বাংলার প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর।
লেখাপড়া:
তখনকার দিনের রেওয়াজ ছিল খানদানী
পরিবারের মেয়েরা বাড়ির বাইরে যাবে না। তাদের কাজ শুধু অন্দরমহলে। ছেলেরা
পরিপাটি হয়ে যেত স্কুলে। ছোট্ট সুফিয়ার এ নিয়ম মোটেই পছন্দ হল না।
নাছোড়বান্দা মেয়েকে নিয়ে কী করবেন মা? অগত্যা তিনি তাকে ছেলের সাথে তাকেও
ছেলেদের পোশাক পরিয়ে টুপি মাথায় চাপিয়ে দিয়ে ছেলেদের সাজে পাঠাতে লাগলেন
স্কুলে। এ নিয়ম বেশিদিন চললো না। ভাই পড়তে গেলো অন্য শহরে আর তাঁরও বন্ধ
হলো স্কুলে যাওয়া৷
কিন্তু এ কিছুতেই মানতে পারলেন না
সুফিয়া। বাড়িতেই টুল, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড সাজিয়ে স্কুলের আদলে চলতে লাগলো
লেখাপড়া। মামাতো ভাইরা তা দেখে ভীষণ অবাক হলেন। ছুটিতে বাড়িতে এলে তারা যোগ
দিতেন এই স্কুল স্কুল খেলায়। এভাবে খেলাচ্ছলে সুফিয়া শিখলেন ইংরেজি,
বাংলা, অংক। ভাইদের তাক লাগিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। পুরস্কারস্বরূপ নিজের
বৃত্তির টাকায় তাঁকে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক করে দিলেন তার ভাই। সে সময়টা
এমন ছিল যে পত্রিকাটি সরাসরি তাঁর নামে ডাকে আসতো না। পাছে লোকে কিছু বলে!
মেয়েদের পড়ালেখাই ছিল নিষেধ। ওখানকার
জুবিলী স্কুলের পন্ডিত মশায়ের সাহায্যে পোস্ট অফিস থেকে কৌশলে গোপনে
পত্রিকাটি তাঁর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা হলো। ভাইয়ের পাঠানো বইগুলো তাঁর
কাছে ছিল মণি-মুক্তার চেয়েও দামী। সাত বছর বয়সে মায়ের সাথে কলকাতায় এক
আত্নীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান তিনি। শান্তশিষ্ট মিষ্টভাষী সুফিয়াকে সকলে খুব
আদর করতেন। সে বাড়িতে একদিন এলেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন।
তাঁকে দেখে মুগ্ধ হন সুফিয়া। রোকেয়া তাঁকে
দেখে আদর করে বলেন, “এই মেয়ে, পড়ছো তো?” মায়ের ইচ্ছা ছিল সুফিয়া বেগম
রোকেয়ার স্কুলে পড়ুক। কিন্তু তাঁরা তো কলকাতায় থাকতেন না। আর স্কুল, কলেজে
পড়া হয়নি সুফিয়ার। অনেক কাল পরে বেগম রোকেয়া আক্ষেপ করেছিলেন। তবে সুফিয়া
কামাল হারিয়ে যাননি। তাঁর ভেতরে যে সাহিত্যের বীজ ছিল তা ধীরে ধীরে ডালপালা
ছড়িয়ে মহীরুহ হয়ে ওঠে।
সাহিত্যের পথযাত্রা:
বাড়িতে লেখাপড়া চলছিলো। নিজের আগ্রহের
কারণে কখনো হারিয়ে যাননি। আত্মবিশ্বাস তাঁকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। রাত জেগে
গোপনে আর দিনের বেলা কাজের ফাঁকে দরজা বন্ধ করে লিখতেন। স্মৃতিচারণ করেছেন,
“এমনি কোনো বর্ষণমুখর দিনে মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল
ইসলামের লেখা ‘হেনা’ পড়ছিলাম বানান করে। প্রেম, বিরহ, মিলন এসবের মানে কি
তখন বুঝি? তবু যে কী ভালো, কী ব্যথা লেগেছিল তা প্রকাশের ভাষা কি আজ আর
আছে?
গদ্য লেখার সেই নেশা। এরপর প্রবাসী
পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়তে পড়তে অদ্ভুত এক মোহগ্রস্ত ভাব
এসে মনকে যে কোন্ অজানা রাজ্যে নিয়ে যেতো। এরপর দেখতাম রোকেয়া সাখাওয়াত
হোসেন, বেগম সারা তাইফুর লিখছেন। কবিতা লিখছেন বেগম মোতাহেরা বানু। মনে
হলো ওরা লিখছেন আমিও কি লিখতে পারি না? শুরু হলো লেখা লেখা খেলা। কী গোপনে,
কত কুণ্ঠায়, ভীষণ লজ্জার সেই হিজিবিজি লেখা ছড়া, গল্প।
কিন্তু কোনোটাই কি মনের মতো হয়! কেউ
জানবে, কেউ দেখে ফেলবে বলে ভয়ে ভাবনায় সে লেখা কত লুকিয়ে রেখে আবার দেখে
দেখে নিজেই শরমে সংকুচিত হয়ে উঠি।”
১২ বছর বয়সে প্রথম গল্প “সৈনিক বধূ”
ছাপা হয় “তরুণ” নামের একটি মাসিক পত্রিকায়। ষোল বছর বয়সে প্রথম গল্পের বই
“কেয়ার কাঁটা” প্রকাশিত হয়। ১৯২৪ সনে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ
নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত
আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায়
উৎসাহিত করেন।
সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে
সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি
সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ১৯১৮ সালের পর সুফিয়া কামালের শিশুমনে
বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলো বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের
কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার। তাঁর অনেক গল্প, কবিতা আমাদের
স্কুল কলেজের পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ছোটবেলায় আমরা সবাই তাঁর
লেখা পড়েছি -” গোল কোরো না ছোটন ঘুমায় খাটে।” বিয়ের পর কলকাতা বসবাসকালে
সুযোগ হয় কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, লীলা রায়ের সান্নিধ্যে আসার। এতে তাঁর মধ্যে
নতুনভাবে আগ্রহ জন্মায়। সাহিত্য সেবায় উজ্জীবিত হন তিনি।
মাসিক ‘সওগাত’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা ‘সাঁঝের
মায়া’ পড়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুগ্ধ হন৷ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আর্শীবাণী পাঠান। সেই সময়ে একজন মুসলিম নারীর এই সাফল্য সবাইকে মুগ্ধ করে।
১৯৩০ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রথম মহিলা সংখ্যায় তাঁর লেখার সাথে ছবি
ছাপানো হয় যা সেই সময়ে ছিল অত্যন্ত সাহসের কাজ। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা
সংগ্রামের সময় তিনি ‘একাত্তরের ডায়েরী’ নামে একটি অসাধারণ দিনলিপি রচনা
করেন। এই সময়ে লেখা তাঁর কবিতা নিয়ে পরে প্রকাশিত হয় “মোর যাদুদের সমাধি
’পরে” নামের একটি বই। ‘একালে আমাদের কাল’ নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছেন
তিনি। এছাড়াও কেয়ার কাঁটা, মায়া কাজল, মন ও জীবন, উদাত্ত পৃথিবী,
অভিযাত্রিক তাঁর রচিত গ্রন্থ। বহু বিদেশী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে তাঁর
লেখা।
সমাজকর্ম:
সুফিয়া কামাল সমাজ ও দেশের জন্য
ভাবতেন৷ যে কোনো আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রিয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,
১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন সক্রিয়।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি হানাদারদের ভয়ে ভীত ছিলেন না। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য
করেছেন। তাঁর জীবন ছিল সংগ্রামের। সমাজ সংস্কারে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর
বিদ্রোহী চেতনা, আত্মবিশ্বাস ছিল অসাধারণ।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি মেয়েদের
সংগঠিত করেন। মিছিল করেন, বক্তৃতা দেন। তিনি নারীদের আলোর দিশারী। ১৯৪৭
থেকে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে জাতীয় সব সংকটে
রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক বিবেকের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
সামরিক শাসনের গণবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, রাজবন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তির
দাবিতে, রবীন্দ্রশতবর্ষ উদ্যাপনের দাবিতে ও দাঙ্গা প্রতিরোধে সুফিয়া
কামাল সামাজিক গণমানুষের সর্বাধিনায়কের ভূমিকায় একাধারে ছায়ানট,
কচিকাঁচার মেলা, পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সংসদ প্রতিষ্ঠা ও নারী আন্দোলনের
মহিলা সংগ্রাম পরিষদ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি:
সুফিয়া কামাল ছিলেন একজন অসাধারণ কবি,
লেখিকা। বিশেষত তাঁর সময়ে একজন বাঙালি মুসলিম নারীর পক্ষে সাহিত্যচর্চা সহজ
কাজ ছিল না। সাহিত্য সাধনা ও সামাজিক আন্দোলনের স্বীকৃতি হিসেবে জীবনে
অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি
পুরস্কার সহ ৫০টির বেশি পুরস্কার লাভ করেন। আইয়ুব খানের স্বৈর শাসনের
প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব
প্রত্যাখ্যান করেন। সৎ, নির্লোভ, নিরহংকারী সুফিয়া কামাল বাংলা সাহিত্যে যে
অবদান রেখেছেন তা প্রশংসনীয়।
মৃত্যু:
১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর এই আলোর পথের পথিক
মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন। প্রতি বছর এই
দিনটিতে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করা হয়।
কিছু কিছু মানুষ আছে, যাদের কথা ও কাজ
তাদের চলার পথে চারপাশের মানুষের মাঝেও প্রাণসঞ্চার করে এবং তাদের
কর্মস্পৃহা বাড়িয়ে দেয়। সুফিয়া কামাল ছিলেন তেমনই একজন আলোর দিশারী। যদি
কাউকে ডেকে বলা হয় যে-“শোনো, তুমি হচ্ছো মেয়ে, তুমি তো বাইরে যেতে পারবে
না”। তখন কি আর সেই ঘরের কোণে বসে বসে ভাবা যায় জ্ঞান অর্জনের কথা নাকি
সেইসব প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে কেউ পড়ালেখা করতে পারে!
এমনই এক সময়ে জন্মেছিলেন প্রিয় কবি
সুফিয়া কামাল। জীবনের সেই শুরুর লগ্ন থেকেই প্রতিনিয়ত হাজারো সমস্যা কাটিয়ে
যে মহীয়সী নারী নিজেকে সুশিক্ষিত করেছিলেন, অন্যদের শিক্ষিত হতে উৎসাহিত
করেছিলেন, তিনিই আমাদের প্রিয় কবি সুফিয়া কামাল।
২০ জুন তাঁর জন্মদিনে গুগুল তাদের লোগো
পরিবর্তন করে। বিভিন্ন দিবস, ব্যক্তি ও ঘটনার স্মরণে গুগল তাদের হোম পেজে
বিশেষ লোগো ফুটিয়ে তোলে, যা ডুডল হিসেবে পরিচিত। এর আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন
দিবস ও ব্যক্তির স্মরণে এ ধরনের ডুডল প্রকাশ করে গুগল। ২০ জুন কবি সুফিয়া
কামালের জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে এভাবে স্মরণ করা হয়।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
আলোর দিশারী – হোসনে আরা শাহেদ
0 Comments